Monday, 20 January 2025

ব্ল্যাক মানডে, বিনিয়োগের ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির পাঠ

 ১৯৮৭ সালের ১৯শে অক্টোবর—ইতিহাসে এই দিনটি "ব্ল্যাক মানডে" নামে পরিচিত। এই দিনে বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারে বড় ধরনের পতন ঘটে। ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ একদিনেই ২২.৬% কমে যায়। বিনিয়োগের জগতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে পরিচিত, যা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অপরিহার্যতা এবং আর্থিক বাজারে বৃহৎ-পরিসরের ঝুঁকির সম্ভাবনা সামনে নিয়ে আসে।

ব্ল্যাক সোয়ান এবং বিনিয়োগের ভবিষ্যদ্বাণীর সীমাবদ্ধতা

“ব্ল্যাক সোয়ান” বলতে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা বোঝায় যা প্রচলিত ভবিষ্যদ্বাণীর মডেলগুলির মাধ্যমে আগে থেকে ধরা যায় না। ঐতিহ্যবাহী ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেলগুলি, যা সাধারণত অতীতের তথ্য এবং "নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন" বা সাধারণ বিতরণের উপর ভিত্তি করে কাজ করে, ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্টগুলিকে সঠিকভাবে অনুমান করতে ব্যর্থ হয়।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি জনপ্রিয় উক্তি হলো, "Nobody knows nothing." অর্থাৎ, কেউই নিশ্চিতভাবে কিছু জানে না। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ একটি যাত্রা, কোনো গন্তব্য নয়। এই যাত্রায় কখনও শীর্ষে উঠতে হবে, কখনও তলায় নামতে হবে, আবার মাঝখানে অসংখ্য ওঠা-নামা থাকবে। তাই ভবিষ্যদ্বাণী করা একেবারেই অর্থহীন।

দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি: বিনিয়োগের সাফল্যের চাবিকাঠি

বিনিয়োগ থেকে লাভ আসে ধাপে ধাপে, যা শুধুমাত্র সময়ের পরে স্পষ্ট হয়। তাই দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগের একটি বড় শিক্ষা হলো—
"Time is your friend; impulse is your enemy."
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সময় সবচেয়ে বড় বন্ধু, আর অস্থিরতা সবচেয়ে বড় শত্রু। ধৈর্য ধরে সময়কে আপনার পক্ষে কাজ করতে দেওয়াই সাফল্যের আসল পথ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, "In investing, what is comfortable is rarely profitable."
অর্থাৎ, যা আরামদায়ক মনে হয়, তা প্রায়ই লাভজনক নয়। লাভের জন্য ঝুঁকি নিতেই হবে এবং তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।

বিনিয়োগ: উত্তেজনার নয়, ধৈর্যের খেলা

বিনিয়োগ সবসময়ই নিস্তরঙ্গ এবং ধৈর্যের খেলা। উত্তেজনার জন্য যদি কেউ বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে তাকে লাস ভেগাস যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। বিনিয়োগ এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ধারাবাহিকতা এবং সংযম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

"Excellence is not an act; it's a habit."
অর্থাৎ, শ্রেষ্ঠত্ব কোনো একক কাজ নয়, বরং এটি ধারাবাহিক অভ্যাসের ফল। বিনিয়োগেও একই কথা প্রযোজ্য। সঠিক পরিকল্পনা, নিয়মানুবর্তিতা, এবং ধৈর্যের অভ্যাসই একজন বিনিয়োগকারীকে সফল করে তোলে।

ঝুঁকি এবং অস্থিরতা: বিনিয়োগের অন্তর্নিহিত খরচ

বিনিয়োগের একটি বড় সত্য হলো, প্রত্যেক জিনিসের একটি খরচ আছে। এবং বিনিয়োগের খরচ হলো অস্থিরতা। কেউ যদি সফল হতে চান, তাকে এই অস্থিরতাকে মেনে নিতে হবে এবং তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

বুদবুদ এবং ভবিষ্যৎ পাঠ

বিনিয়োগের জগতে বুদবুদ বা "বাবল" প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়। এটি ক্যানসারের মতো নয়, যা একটি বায়োপসি রিপোর্টের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বরং এটি অনেকটা রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতনের মতো, যার ফলাফল আমরা পরবর্তীতে বুঝতে পারি, কিন্তু কারণ বা দোষ কার তা নিয়ে সর্বদা বিতর্ক থেকে যায়।

সমাপ্তি

বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এটি ধৈর্য, পরিকল্পনা এবং ঝুঁকি মেনে নেওয়ার ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। যারা এই তিনটি গুণের সঙ্গে বিনিয়োগের পথে হাঁটতে পারেন, তারাই শেষ পর্যন্ত সফল হন। আর সাফল্য কেবল একটি গন্তব্য নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদী যাত্রার ফল।

Sunday, 5 January 2025

ব্যাংক এফডি নিরাপদ, কিন্তু সত্যিই কি ঝুঁকিমুক্ত?

 আমাদের চারপাশে অনেক বিনিয়োগকারী আছেন, যারা বিশ্বাস করেন ব্যাংকে টাকা রাখা একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত। তাদের কাছেসেফটিসবথেকে মূল্যবান। বিষয়ে আমি কিছুটা একমত হলেও পুরোপুরি একমত নই। কারণ ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের ধারণা আসলে কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ঝুঁকিএকটি আপেক্ষিক শব্দ

ঝুঁকিশব্দটি আপেক্ষিক। যা একজনের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ, তা হয়তো অন্যের কাছে নিরাপদ। তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। অর্থাৎ, আজ যে জিনিস কিনতে পারছি, ভবিষ্যতে যদি সেটা আর কিনতে না পারি, সেটাই প্রকৃত ঝুঁকি।

আলোচনাটি সহজে বোঝাতে একটি উদাহরণ ধরি। রামবাবু, রহিম বাবু এবং অসীম বাবুতিনজনেরই হাতে ১০০ টাকা আছে। আজ চালের দাম যদি প্রতি কেজি ৫০ টাকা হয়, তাহলে তিনজনই দুকেজি চাল কিনতে পারবেন। কিন্তু তারা আজ চাল না কিনে সেই ১০০ টাকা ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখলেন। দশ বছর পর কী হতে পারে, তা দেখা যাক

রামবাবু: তিনি তার টাকা আলমারিতে রেখে দিলেন। দশ বছর পরে তিনি চাল কিনতে গেলে দেখবেন, সেই ১০০ টাকায় এক কেজিরও কম চাল পাবেন, কারণ চালের দাম তখন অনেক বেড়ে গেছে।

রহিম বাবু: তিনি টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি) করেছেন। সুদ-আসল মিলিয়ে তিনি নিশ্চিতভাবে ১০০ টাকার চেয়ে বেশি টাকা পাবেন। কিন্তু চাল কিনতে গেলে দেখা যাবে, তিনি দুকেজি চালের থেকেও কম পাবেন।

অসীম বাবু: তিনি তার টাকা মিউচুয়াল ফান্ড বা অন্য কোনো বিনিয়োগে ব্যবহার করেছেন। দশ বছর পরে দেখা যাবে, তার বিনিয়োগ থেকে এমন পরিমাণ টাকা এসেছে, যা দিয়ে তিনি  / কেজি চাল কিনতে পারবেন।

এখান থেকেই স্পষ্ট, ব্যাংকে টাকা রাখলে ঝুঁকি থাকে নাএই ধারণা পুরোপুরি ভুল।

ব্যাংক এফডি: ভালো না খারাপ?

আমি কখনোই বলছি না যে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট খারাপ। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থা টিকে রয়েছে, এর মানে এর কিছু ভালো দিক রয়েছে। কিন্তু এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে।

ভালো দিক:

  1. ব্যাংক এফডি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
  2. বাজারের ওঠাপড়ার প্রভাব এফডি-তে পড়ে না।

খারাপ দিক:

  1. ইনফ্লেশন (মূল্যস্ফীতি): ইনফ্লেশনের ফলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে এফডি থেকে প্রাপ্ত সুদ প্রায়ই ইনফ্লেশনের তুলনায় কম থাকে।
  2. দীর্ঘমেয়াদে এফডি মূলধনের প্রকৃত মূল্য রক্ষা করতে পারে না।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি সম্ভাবনা

বিনিয়োগ বিশেষত মিউচুয়াল ফান্ডে, স্বল্প মেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর তুলনায় নিরাপদ বিকল্প খুব কমই আছে।

বিনিয়োগের মাধ্যমে আপনি শুধু আপনার মূলধন রক্ষা করতে পারবেন না, বরং তা বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারবেন। দীর্ঘমেয়াদে মিউচুয়াল ফান্ডের ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে এটি মূল্যস্ফীতির চেয়েও বেশি রিটার্ন দিতে সক্ষম।

সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়

মিউচুয়াল ফান্ড বা ব্যাংক এফডিযেটিই বেছে নিন, তা আপনার আর্থিক লক্ষ্য, সময়কাল এবং ঝুঁকির প্রতি মনোভাবের উপর নির্ভর করে। তবে এই একটি বিষয় স্পষ্টআর্থিক পরিকল্পনা করার সময় শুধুমাত্র সুরক্ষা নয়, ক্রয়ক্ষমতার বিষয়েও ভাবা উচিত।

অর্থাৎ, সেফটি এবং রিটার্নের মধ্যে একটি ভারসাম্য খুঁজে বের করাই একজন সফল বিনিয়োগকারীর আসল চ্যালেঞ্জ।